বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০২:০৪ পূর্বাহ্ন
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিনের শেষ সময় পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করছে – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হতে যাচ্ছেন, সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৫৯ আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। এরপর গোটা জাতি – সমগ্র বিশ্ব নিশ্চিত হয়ে আছেন, পাকিস্তানের শাসনভার আওয়ামী লীগের উপর ন্যস্ত হতে যাচ্ছে। ডিসেম্বর শেষ হলো, জানুয়ারী শেষ হলো, ফেব্রুয়ারী শেষ হয়ে যাচ্ছে তবুও সামরিক সরকার ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করছেন না। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চ ক্ষমতা হস্তান্তরের শেষ দিন।
২৮ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দিবেন। সবাই নিশ্চিত ছিলেন, ঐদিনই হয়তো ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন ধার্য করা হবে। গোটা বাঙালী জাতি অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন। রেডিও সামনে ছোট বড় সবাই বসে আছেন – ইয়াহিয়ার ঘোষনা শুনার জন্য। তেমন একটি মুহুর্তের কথা বলতে গেলে বলতে হবে, রেডিও হলো একমাত্র সংবাদ জানার মাধ্যেম। পাবনা শহরে তখন হাতে গোনা ৩/৪ টা টেলিভিশন। আর রেডিও সেটাও অপ্রতুল। পাড়া মহল্লায় দুই চারটা রেডিও। গ্রাম এলাকায় চেয়ারম্যান – মেম্বার বা গ্রামের বড়লোকের বাড়ী ছাড়া কারো রেডিও নাই।
২৮ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দিতে বসলেন । তাঁর ভাষনের শুরু থেকে শেষ হয়ে আসছে তবুও ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা নাই। শেষ লাইনে উচ্চারণ করলেন, জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনিদিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো। ঠিক তেমন মুহুুর্তটি এখনো মানসপটে অমলিন হয়ে আছে। বলা যায় বিনামেঘে বজ্রপাত হলো। গোটা দেশে বজ্রপাতের আগুনে লেলিহান শিখার মত জ্বলে উঠলো। চারিদিকে তখন জয় বাংলা আর জয় বাংলার গগনবিদারী শ্লোগান। ক্ষোভে – বিক্ষোভে গোটা দেশের মানুষ ফেটে পড়লো। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – সর্বত্র তখন জয় বাংলা।
১ মার্চ থেকে শুরু হলো হরতাল। অনিদিষ্ঠকালের জন্য বন্ধ ঘোষনা। শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসু’র ভিপি আ স ম আব্দুর রব মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করলেন। ( যে পতাকা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ব্যবহার করা হয়েছে।) ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা ঘোষনা করে, আমার সোনার বাংলা – আমি তোমায় ভালবাসি ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত সংগীত ) কে জাতীয় সংগীত করে স্বাধীন বাংলাদেশ এর রুপরেখা ঘোষনা করা হয়। অতঃপর বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিক গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। মূলতঃ তখন থেকেই শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম।
১ থেকে ৭ মার্চ গোটা পূর্ব বাংলা তখন বাঙালীর বাংলাদেশ। আমি কে তুমি কে – বাঙালী বাঙালী। আমার তোমার ঠিকানা – পদ্মা মেঘনা যুমনা। ঢাকা না পিন্ডি – ঢাকা ঢাকা। আমার দেশ তোমার দেশ – বাংলাদেশ বাংলাদেশ। বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো – বাংলাদেশ স্বাধীন করো। পাড়া – মহল্লায়, গ্রাম – গঞ্জে সর্বত্র ছাত্র – যুবক, তরুন – তরুনী তখন ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছে। প্রতিদিন মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত গোটা দেশ। পাড়া মহল্লায় তরুন যুবকদের সংগঠিত করা হচ্ছে – মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। শত্রুদের পথরুদ্ধের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ব্যাড়িকেড দেওয়া হচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় তরুন যুবকদের সংগঠিত করে সামরিক প্রশিক্ষনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আমাদের এলাকা সহ সমস্ত এলাকায় একই চিত্র।
পাবনার ঐতিহ্যবাহী রাধানগর এলাকা তখন রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ন স্থান। এডওয়ার্ড কলেজ এবং রাধানগর মজুমদার একাডেমী হতে ছাত্র রাজনীতি চালিত হতো। তৎকালীন সময়ে এই এলাকা ছিল আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্ত প্রতিপক্ষ এবং ছাত্রলীগের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল ছাত্র ইউনিয়ন ( মেনন গ্রুপ)। মুলদল হলো ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ( ন্যাপ – ভাসানী)। পাবনায় তখন ছাত্র ইউনিয়ন ( মেনন গ্রুপ) টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বে মুলদল থেকে বিছিন্ন হয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতা চারু মজুমদারের অনুসারী হয়ে নক্সাল পন্থী হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তারা পাবনায় শ্রেনী শত্রু খতমের নামে সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করে দেয়। তাঁরা শ্রেনী শত্রু বিরোধী রাজনীতি করার কথা বললেও মুলতঃ তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগকে মনে করতো। তারা ১৯৭০ সালের ২২ ডিসেম্বর পাবনা শহরের দক্ষিণ রাঘবপুর মহল্লায় নব নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ( এমপিএ) আহমেদ রফিককে বিজয়ী হওয়ার পাঁচদিন পর নির্মমভাবে হত্যা করে। ( এই দলটি নয় মাস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল।)
তৎকালীন সময়ে রাধানগর ( পৈলানপুর) এলাকায় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুস সাত্তার লালু’র বাড়ী ছিল। রাধানগর এলাকার মোখলেছুর রহমান মুকুল ( মুক্তিযোদ্ধা) সাঈদ আকতার ডিডু ( মুক্তিযোদ্ধা), সাইফুল ইসলাম বাবলু ( মুক্তিযোদ্ধা) ও মিজানুর রহমান তরুণ ( মুক্তিযোদ্ধা) ছিল জেলা ছাত্রলীগের নেতা। এলাকা ভিত্তিক প্রধান নেতা ছিলেন, মক্তব পাড়ার আব্দুল মান্নান গোরা ( মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার) । এছাড়া আওয়ামী লীগের রমজান আলী, মোহরম আলী ( শহীদ মুক্তিযোদ্ধা) সোলায়মান দোকানদার ( মুক্তিযুদ্ধের সময় নক্সাল বাহিনীর হাতে নিহত), কামরুল ইসলাম ফুটু ( মুক্তিযোদ্ধা) , আব্দুল কাদের, ওহিদুর রহমান প্রমুখ। পৈলানপুর এলাকায় ছিলেন, দেওয়ান মাহবুবুল হক ( ফেরু দেওয়ান), আবুল কাশেম উজ্জ্বল, আব্দুল লতিফ সেলিম ( মুক্তিযোদ্ধা) আব্দুল্লাহ হেল কাফি ( মুক্তিযোদ্ধা) শফিকুর রহমান শফি ( মুক্তিযোদ্ধা), দেওয়ান মাহমুদুল হক দুলাল ( মুক্তিযোদ্ধা) প্রমুখ।
পরিশেষে আমি এবং ৭ মার্চের কথা। আমি ১৯৬৭ সালের শুরু থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়ি। পাবনার ঐতিহ্যবাহী রাধানগর মজুমদার একাডেমী ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক ও পরবর্তীকালে সভাপতি, ১৯৬৯ সালে গন আন্দোলনে বৃহত্তর পাবনা জেলা স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক, ১৯৭০ সালে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বই বাতিলের আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্বে জড়িত ছিলাম। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর পাবনা আগমন টাউন হলের জনসভায় অবস্থান, ৬৭ সালে পাবনায় ভুট্টা আন্দোলনে উপস্থিতি থাকা সহ ৬৮ এবং ৬৯ সালের আন্দোলন, সংগ্রাম ও মিছিল সমাবেশে সক্রিয় উপস্থিত থাকতাম। ৬৮ ও ৭০ সালে ঢাকায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সম্মেলনে উপস্থিত থেকেছি। ৭০ সালে পাবনায় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়ে আমার লেখা কবিতা শুনিয়েছি। ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ নির্বাচন এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনী প্রচারনা সহ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিনের ঘটনার সাথে জড়িত থাকার চেষ্টা করেছি।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দান থেকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দিবেন। সমস্ত মানুষের উৎকন্ঠা। কি হবে – কি করবেন – কি বলবেন, সেই নিয়ে কানা ঘুষা। কেউ বলছেন বঙ্গবন্ধু ঐদিনই স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন। কেউ বলছেন, বঙ্গবন্ধু ঐদিন স্বাধীনতার ঘোষনা দিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিমান থেকে বোমা বর্ষন করবেন। কেউ বলছেন বঙ্গবন্ধু ঐদিন রেসকোর্স ময়দানে যাবেন না। তাঁকে দলের শীর্ষ নেতারা যেতে দিবেন না। পূর্বেই ঘোষনা করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষন রেডিও তে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। সারাদেশের মানুষ রেডিও’র সামনে বসে আছে। আমি সেদিন বাড়ীর পাশে মক্তব স্কুলের পাশে মোহররম আলীর ( শহীদ মুক্তিযোদ্ধা) সাইকেল মেকারের দোকানের সামনে বসে আছি। পাশে সোলায়মান দোকানদার ( নক্সালদের হাতে শহীদ) এর ওখানে রেডিও। মুরুব্বীরা ওখানে আর তরুন যুবকরা এখানে। দুপুরের আগে থেকে বসে আছি। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে অথচ ভাষন হচ্ছে না। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, গত ১ মার্চ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত রেডিও ছিল বাঙালীদের দখলে। এ কয়দিন ধরে রেডিওতে দেশাত্মবোধক অনুষ্ঠান প্রচার হলেও ৭ মার্চ দুপুরের আগেই রেডিও স্টেশন পাকিস্তান সেনাবাহিনী দখল করে নেয়। ফলে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনটি আর রেডিওতে প্রচার করা হয়নি। এমতাবস্থায় গোটা দেশের মানুষ আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। এরপর আমরা মক্তব থেকে মিছিল নিয়ে শহরের যাই। শহরের প্রধান সড়ক মানে আব্দুল হামিদ রোডে হাজার হাজার জনতা। বিভিন্ন পাড়া মহল্লা থেকে মিছিলে মিছিলে শহর উত্তাল হয়ে উঠেছে।
৮ মার্চ সকালে জানা গেল বঙ্গবন্ধুর গতকালের ভাষন আজ রেডিওতে প্রচার করা হবে। সাথে সাথে চারদিক থেকে জয় বাংলা – জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠলো। দৌড়ে মক্তব গিয়ে দেখি মোহররম আলীর দোকানের সামনে শত শত মানুষের ভীড়। শহর থেকে মাইক ভাড়া করে আনা হয়েছে। রেডিও’র থেকে প্রচারিত ভাষন মাইকের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষকে শোনানো হবে। সেদিনের সেই অনুভূতির কথা স্মরণ হলে শরীরের সমস্ত পশম দাড়িয়ে যায়। এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ – শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর ভাষন। সেই ১৮ মিনিটের ভাষন এখনো কানে বাঁজে। সেই ভাষনের শেষ লাইন হলো সাড়ে সাতকোটি বাঙালীর প্রতিপাদ্য ধ্বনি — ❤ এবাবের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম – এবাবের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ❤ শুরু হলো বাঙালীর স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষনা করা হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার বীজ বোপন করেছিলেন ১৯৬২ সালে আর তা অঙ্কুরিত হয় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ।
সমাপ্ত –
লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
৭ মার্চ ২০১৯