সোমবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২১, ০১:২৩ অপরাহ্ন
আটঘরিয়ার ৩ বীরাঙ্গনার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি
শহর প্রতিনিধি : পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান গবেষক ডক্টর এম আব্দুল আলীমের ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার তিন বীরাঙ্গনা। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)-এর গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে তাদের এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
গত বছর অক্টোবরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর টনক নড়ে প্রশাসনের। তারই প্রেক্ষিতে তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। গত ১৭ নভেম্বর জামুকা এই গেজেট প্রকাশ করে।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া তিনজন হলেন পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার খিদিরপুর গুচ্ছগ্রামের মৃত নুনে সরকারের স্ত্রী সোনা বালা, শ্রী আশুপদ’র স্ত্রী মায়া রাণী, একই উপজেলার কন্দর্পপুর গ্রামের মৃত বেলায়েত প্রামানিকের মেয়ে জামেলা খাতুন।
সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন এই নারী মুক্তিযোদ্ধারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একাত্তরের ২২ অক্টোবর সন্ধ্যায় বাড়িতে রান্না করছিলেন অবিবাহিত সোনা বালা ও তার ভাবী মায়া রানী। এ সময় স্থানীয় আব্দুল মমিন রাজাকারের নেতৃত্বে ৫/৭ জন বাড়িতে হানা দিয়ে জোরর্পূবক তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালায়।
তাদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুঁটে গেলে তাদের ফেলে পালিয়ে যায় রাজাকারের দল। খবর পেয়ে তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাহজাহান আলী ও কমান্ডার আনোয়ার হোসেন রেনুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বেরুয়ান নামক স্থানে রাজাকারদের উপর হামলা চালান।
মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের সম্মুখ যুদ্ধে কয়েকজন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মমিন রাজাকারসহ ১০ রাজাকার নিহত হয়।
একইভাবে নির্যাতন চালানো হয় কন্দর্পপুর গ্রামের জামেলা খাতুনের ওপর।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একে একে কেটে গেছে প্রায় ৪৫ বছর। একাত্তরের দূর্বিষহ যন্ত্রণা, সামাজিক লাঞ্ছনা নিয়ে চলছিল পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার তিন বীরাঙ্গনা সোনা বালা, মায়া রানী ও জামেলা খাতুনের জীবন সংগ্রাম।
অন্যের জমিতে বসবাস ও দিনমজুরী করে, খেয়ে না খেয়ে চলছে দিন। প্যারালাইসিসে আক্রান্ত স্বামী বিছানায় পড়ে আছে মায়া রানীর, আর স্ট্রোক করে বর্তমানে কর্মক্ষমতা হারিয়ে অসুস্থ্য সোনা বালা। সরকার বিভিন্ন সময়ে বীরাঙ্গনা নারীদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিলেও কোনো তালিকায় নাম ছিল না তাদের।
অবশেষে জীবন সায়াহ্নে এসে পেলেন বীরাঙ্গনা নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।
বীরাঙ্গনা নারী মুক্তিযোদ্ধা মায়া রানী বলেন, ‘জীবনের শেষ সময়ে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের যে সম্মান দেখালো, তা ভুলবার নয়। ক’দিনই বা বাঁচবো। সম্মান নিয়ে মরতে সুযোগ দেওয়ার জন্য তাকে ধন্যবাদ।
আমাদের বংশধররা বলতে পারবে আমরা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য।
আর বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা সোনা বালা জীবনের সায়াহ্নে এসে আবেগে আপ্লুত। তিনি বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিকরা আমাদের জন্য যা করলেন, তা স্মরণীয়। আপনাদের ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা নেই। মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছি। এতে দেশের জন্য কিছু করেছি বলে গর্ব হচ্ছে।
আটঘরিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার জহুরুল হক বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর হলেও আজ ভালো লাগছে এ জন্যে যে, অসহায় এই নারীদের সরকার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
তাদের জন্য সরকারি সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে বাকি যা কাজ আছে তা দ্রুতই করবেন বলে জানালেন এই মুক্তিযোদ্ধা।
আটঘরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলীমুন রাজীব বলেন, ‘বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর গত ১৭ জুলাই এই বীরাঙ্গনা মহিয়সী নারীদের মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভূক্ত করার জন্য কাগজপত্র মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। গণমাধ্যমের মাধ্যমেই জানতে পারি তাদের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভূক্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। জেনে সত্যিই আনন্দ লাগছে।
তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘খুব শিগরিই বদলী হতে হবে এই উপজেলা থেকে। কিন্তু যাবার বেলায় একটা ভালো কাজ করে যেতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে।’
ইউএনও রাজীব আরো বলেন, ‘আগামী ১৬ ডিসেম্বর এই তিন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে বিশেষভাবে সংবর্ধণা দেওয়া হবে। পাশাপাশি তাদের জন্য সরকারি সুযোগ সুবিধা দ্রুত নিশ্চিত করতে আমার পক্ষ থেকে যা যা করার সব করা হবে।’
গবেষক ডক্টর এম আব্দুল আলীম একজন বীরাঙ্গনার সাক্ষাতকার নিচ্ছেন
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান গবেষক ডক্টর এম আব্দুল আলীম বলেন, ‘নিজস্ব ঘর বাড়ি নেই, পরের জায়গায়, পরের জমিতে কাজ করে দিন চলছিল এই বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা নারীদের।
জীবন সায়াহ্নে এসে দাঁড়িয়েছেন আজ তারা। গণমাধ্যমের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণেই আজ তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন।’
সরকারের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি মানবেতর অবস্থায় থাকা এই নারীদের জন্য সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা দ্রুত নিশ্চিত করার দাবি জানান।
© All rights reserved 2020 ® newspabna.com