শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২১, ০৮:৫৯ অপরাহ্ন
বার্তা সংস্থা পিপ, পাবনা : ঈশ্বরদীর পাকশীতে পদ্মা নদীর ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ ব্রিজের খুব কাছাকাছি স্থানে নদী দখল করে পাহাড়সম বালু স্তুপ করে রাখার কারনে পদ্মার এই ভরা মৌসুমে নদীর গতিপথই পরিবর্তন হয়ে গেছে।
একইসাথে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিরাপদ দুরত্বের মধ্যে নদীতে ‘চুপেচাপে’ ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করার কারনে নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।
সরেজমিন পদ্মা নদীতে গিয়ে দেখা গেছে, ভরা বর্ষা মওসুম আর পদ্মার তীব্র স্রোত উপেক্ষা করে নদী থেকে বালু উত্তোলন, নদীর স্বাভাবিক গতিরোধ ও বাঁধ দিয়ে রিতিমত পাহাড়সম বালুর মজুদ করে বালু বানিজ্যে মেতে উঠেছেন ঈশ্বরদীর প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ীরা।
পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহসভাপতি ও পাকশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস এই বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করেন।
বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সবাই ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী ও দলীয় সূত্র।
সূত্র জানায়, পদ্মা নদীর এই বিশাল এলাকা লিজ না নিয়ে লীজ গ্রহীতা কৃষকদের নিকট থেকে ভাড়া নিয়ে সেখানে বালুর ব্যবসা করছেন বালু ব্যবসায়ী আওয়ামীলীগের ‘নির্দিষ্ট’ কয়েকজন নেতারা।
তবে পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল ইসলাম বলেন, এই বালুর ব্যবসার সঙ্গে ইউপি চেয়ারম্যান ছাড়া আওয়ামীলীগের কোন নেতার অংশগ্রহণ নেই।
চেয়ারম্যান একাই এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করেন। রেল সূত্র এবং স্থানীয়রা বলেছেন কৃষি লীজের জমিতে বানিজ্যিকভাবেই চলছে বালুর রমরমা ব্যবসা।
পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনাম বিশ্বাসের ভাগিনা পরিচয়ে আনোয়ার হোসেন প্রতিদিন টাকা উত্তোলনসহ যাবতিয় কর্মকান্ডে সার্বক্ষনিক দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ ও যুবলীগের একাধিক নেতা জানান, ইউপি নির্বাচনের আগে বালু ব্যবসা পরিচালনার জন্য কয়েকজন দলীয় নেতাদের সমন্বয় ছিল, কিন্তু চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি একাই সব বালুমহাল ও বালুর ঘাট নিয়ন্ত্রণ করছেন।
আগে বালু বিক্রির টাকার ভাগ পেলেও এর কোন ভাগও এখন দলীয় কেউ পাননা বলে মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছেন আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একাধিক নেতারা।
স্থানীয়রা জানান, শতবর্ষী ঈশ্বরদীর ঐতিহ্যবাহী ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এবং লালন শাহ সেতুর খুব কাছে থেকে বালু উত্তোলন এই ব্রিজ দুটির জন্য হুমকি ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া স্বত্বেও বালু উত্তোলন থেমে নেই।
বালুর স্তুপ বড় হতে হতে এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে বালুর বিশাল বিশাল স্তুপের আড়ালে ঢাকা পড়েছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতু।
তবে বালুমহালের নেতৃত্বদানকারী পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহসভাপতি এনামুল হক বিশ্বাস বলেছেন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিকট বালু স্তুপ করা হলেও এখান থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছেনা, এ বালু কুষ্টিয়া, আলাইপুর, পাবনাসহ বিভিন্ন ঘাট থেকে নৌকাযোগে এনে নৌকার সাথে ড্রেজিং মেশিন লাগিয়ে বালুর মজুদ করার পর এখান থেকে বিক্রি করা হচ্ছে।
পাকশী পদ্মার এ বালুমহালে থাকা একাধিক বালু ব্যবসায়ীরা জানান, তারা পদ্মা নদীর এসব জমি ভাড়া নিয়ে বালু স্তুপ করে বিক্রি করছেন।
বালু ব্যাবসায়ীরা জানান, প্রতিদিন ঈশ্বরদীর পদ্মা নদীর ৪টি ঘাটে গড়ে প্রায় ১ হাজার ট্রাক বালু বিক্রি হয়। টাকার হিসেবে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকার বালু বিক্রি হয় এসব ঘাট থেকে।
তবে পাকশীর চেয়ারম্যান এই পরিমান ৫ থেকে ৬শ ট্রাক বলে দাবি করেছেন।
সরেজমিনে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকার বালুমহালে গিয়ে দেখা যায়, নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে ঘাটে ট্রাক-ট্রাক্টর আসছে, বালু বোঝাই করে চাঁদার টাকা নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে দিয়ে চলে যাচ্ছে বালু।
বালুঘাটের একজন ম্যানেজার তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এখানে ৬ জন পার্টনার ৬টি বালুর স্তুপ করে ম্যানেজার নিয়োগ করে বালু বিক্রি করছেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় সেতু প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নির্দিষ্ট দুরত্বের কাছাকাছি পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন করলে এই ঐতিহাসিক ব্রিজ হুমকির মুখে পড়বে।
তবে বালুর ব্যবসা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি পাকশীতে নতুন এসেছি, সবকিছু জেনে পরে বিস্তারিত জানাতে পারবো।
এ সব বিষয়ে পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি এনাম বিশ্বাস বলেন, রেজা নামের একজনের নামে এই বালু মহাল লীজ নেওয়া আছে, সে অনুযায়ী অন্য স্থান থেকে বালু এনে এখানে রেখে বিক্রি করা হয়। পদ্মা নদীর বাকি স্থানে কৃষকদের লীজ নেওয়া জমি ভাড়া নিয়ে বালু বিক্রি করা হয়।
পাকশী বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান মুঠোফোনে বলেন, পদ্মা নদীর যে স্থানে বালুর পাহাড় সে জমি রেলের। স্থানীয় কৃষকরা বাৎসরিক কৃষি লীজ নিয়ে এসব জমিতে চাষাবাদ করে থাকেন।
তবে এখন সেখানে চাষাবাদের বদলে বালুর ব্যবসা করা হচ্ছে। রেল কর্তৃপক্ষ এসব জমির কৃষি লীজ বাতিল করে বানিজ্যিক লীজ প্রদানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিহাব রায়হান বলেন, ইতিপূর্বে উপজেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ওই বালু জব্দ করে নিলামে বিক্রি করার এক মাস সময় বেঁধে দিয়েছিল।
এখন যদি বালু ব্যবসায়ীরা আবারো বালুর ব্যবসা চলমান রাখেন তাহলে সরেজমিন তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
© All rights reserved 2020 ® newspabna.com