বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী ২০২১, ০৭:১৭ পূর্বাহ্ন
।। রিজভী জয়।। পাবনায় যথাযথভাবে সংরক্ষণ হচ্ছে না মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। জেলা বাতায়নে তথ্যগত ভুলের পাশাপাশি অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান ও বধ্যভূমিগুলো। স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও সংরক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় ইতিহাস বিকৃতির আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
একাত্তরের মার্চে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাবনার মুক্তিকামী জনতার প্রতিরোধে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকসেনারা। সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে সে জনযুদ্ধের বিজয়ে ২৯ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্ত ছিল পাবনা। কিন্তু এরই মাঝে তারা নৃশংসভাবে পাবনার বিসিক শিল্পনগরীতে হত্যা করে জেলার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ক্রোধে উন্মত্ত পাকসেনারা পরবর্তীতে পাবনার গ্রামে গ্রামে চালায় নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। আজও সেসব নির্মমতার সাক্ষ্য দেয় জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা গণকবরগুলো। ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফেরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা আর আত্মত্যাগে সম্পূর্ণভাবে পাবনা স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে। তবে, সারাদেশ ১৬ ডিসেম্বর বিজয়োল্লাসে মাতলেও পাবনা স্বাধীন হয়েছিল ১৮ ডিসেম্বর। মৃত্যুভয়ে ভীত পাকসেনারা সাহস করেনি পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করার। ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন নন্দা আসার পর তারা আত্মসমর্পণ করে।
পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলাম বলেন, প্রথম দফায় পাকসেনারা পাবনার মুক্তিকামী জনতার কাছে সমূলে নাস্তানাবুদ হওয়ায় ১০ এপ্রিল থেকে তারা পাবনার প্রতিটি এলাকায় শুরু করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় বাড়িতে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট আর ধর্ষণে মেতে ওঠে হানাদার বাহিনী। পাবনা শহরের এমন একটি গলি খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে শহীদের রক্তের দাগ নেই। পাবনার সাতবাড়ীয়া, নাজিরপুর, ডেমরা, ঈশ্বরদীসহ বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়।
এদিকে, স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও গৌরবময় এসব ইতিহাস সংরক্ষণে নেওয়া হয়নি কার্যকর উদ্যোগ। জেলা বাতায়নে সংযুক্ত সংক্ষিপ্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নেই বীর শহীদদের বীরত্বগাঁথা। বলা হয়নি শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনউদ্দিন, ডা. অমলেন্দু দাক্ষী, আবু সাইদ তালুকদারসহ পাবনার সূর্যসন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম ও অবদানের কথা। মুক্তিযুদ্ধে পাবনায় গঠিত ৭ সদস্যের হাইকমান্ড সদস্যদের কয়েকজনের নাম থাকলেও অজ্ঞাত কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে আমিনুল ইসলাম বাদশা ও মাহবুবুল হকের নাম। একটি শব্দও লেখা হয়নি মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী, নকশালদের অপকর্মের বিষয়ে।
দেশের শীর্ষ দুই যুদ্ধাপরাধী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও আব্দুস সুবহানের নির্দেশে পাবনায় অসংখ্য গণহত্যার ঘটনা ঘটলেও অজ্ঞাত কারণে তার উল্লেখ নেই রাষ্ট্রীয় এ ওয়েব পোর্টালে। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর পাবনা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হলেও তথ্য বাতায়নে বলা হয়েছে ১৫ ডিসেম্বর।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রশাসনের অবহেলা আর নজরদারির অভাবে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে গণকবর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো। কোনটি জঞ্জালের স্তুপে ঢাকা, কোথাও আখড়া গেড়েছে মাদকসেবীরা। অবিলম্বে এ স্থানগুলো সংরক্ষণের দাবি পাবনাবাসীর।
এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পাবনা জেলা ইউনিট কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে সংরক্ষণ হচ্ছে না। এ জেলায় রাজাকার আলবদরদের নির্মমতার কথা মনে পড়লে আজও ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। নিজামী, সুবহানসহ জামাতের নেতাকর্মী ও নকশালদের কারণে পাবনায় অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের এমপি, মন্ত্রী করা হয়েছে, শহীদের রক্তস্নাত পতাকা তাদের গাড়িতে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসকে মাটিচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে সংরক্ষণ না করলে রাজাকার আলবদরদের প্রেতাত্মারা ভবিষ্যতে আবারও ইতিহাস বিকৃত করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাতেন বলেন, পাবনার নাজিরপুরে ৬২ জন মুক্তিকামী মানুষকে ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনের যুদ্ধে পাবনাবাসীর প্রতিরোধে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, অথচ নাজিরপুর গণকবর ঝোঁপ ঝাড়ে চেনার উপায় নাই। আর টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবন মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস ও বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, পাবনায় পাকহানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের পৈশাচিকতার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের পরিচিত করতে গণকবর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে সরকারি তথ্যবাতায়নের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভুল তথ্যগুলি দ্রুত সংশোধনের দাবিও জানান তিনি।
তবে, তথ্য বাতায়নের ভুল সংশোধন ও স্মৃতিস্মারক তৈরির আশ্বাস দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এ বিষয়ে পাবনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সালমা খাতুন জানান, সংক্ষিপ্ত সময়ে নির্ধারিত ফরম্যাটে তথ্য বাতায়নে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংযোজন করায় তথ্যগত কিছু ভুল হয়ে থাকতে পারে। তবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে দ্রুত এসব ভুল সংশোধন করা হবে। জেলার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণেও দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
© All rights reserved 2020 ® newspabna.com