মোঃ নূরুল ইসলাম, চাটমোহর, পাবনা : “আমি মেলা থেকে তাল পাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি, বাঁশি কই আগের মতো বাজেনা, মন আর তেমন যেন সাজে না, তবে কি ছেলে বেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি” প্রতিমা বন্দোপাধ্যায় এর কন্ঠে এ গানটি অনেকে অনেক বার শুনেছেন।
আবার, “তাল পাখা হাতে নিয়ে, তোমার শিওরে বসে, নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দেব, ঘুমাও তুমি ঘুমাও তুমি, ঘুমাও তুমি ঘুমাও” জেমসের এ গানটির কথাও অনেকেরই মনে আছে হয়তো। তাল পাখা নিয়ে রচিত এমন আরো অনেক গান, কবিতা আমাদের সাহিত্যে স্থান করে নিলেও আধুনিকতার প্রভাবে সে সাহিত্য এখন ইতিহাসের অংশ হবার উপক্রম হয়েছে। কালের বিবর্তনে তাল পাখার স্থান দখল কাগজ ও প্লাস্টিকের তৈরী পাখা।
ফাল্গুন থেকে ভাদ্র এ সাত মাস আমাদের দেশে অধিক গরম অনুভূত হয়। প্রচন্ড গরমে স্নিগ্ধ শীতল বাতাসের পরশ পেতে পাবনার চাটমোহরের মহেশপুর গ্রামের তাল পাখার কারিগরদের তৈরী তালপাখার বাতাস অতুলনীয়। লোডশেডিং এর সময় যখন বৈদ্যুতিক পাখা বন্ধ থাকে তখন গরীবের একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে তালের পাখা।
এক সময় মহেশপুর গ্রামের দেড় শতাধিক পরিবারের আয়ের উৎস ছিল তাল পাখা তৈরী। গ্রামটি পরিচিতি লাভ করেছিল ‘তালপাখার গ্রাম’ হিসেবে। গরম কালে তালের পাখা বিক্রি করে বাড়তি আয় করতো তারা। গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে পাখা তৈরী করতো। বাড়ির বৌঝি, ছেলে মেয়েরা তাদের এ কাজে সহায়তা করতো। শীতকালে কেউ রিক্সা-ভ্যান চালাতো, কেউ সেলুনে কাজ করতো, কেউ শহরে যেত কাজের সন্ধানে, কেউবা দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে অন্যের বাড়িতে শ্রম বিক্রি করতেন।
ঠিক কবে থেকে এ গ্রামে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয় এর সঠিক কোনো তথ্য কেউ দিতে না পারলেও পাখা তৈরীর কারিগররা জানান বংশ পরম্পরায় তারা এ কাজটি করে আসছিলেন। কালের বিবর্তনে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
তাল পাখা তৈরীর কারিগর, মহেশপুর গ্রামের আঃ কাদের জানান, গত প্রায় ৪০ বছর যাবৎ তাল পাখা তৈরী ও বিক্রি করে আসছেন তিনি। একসময় এ গ্রামের অর্ধেকের বেশি পরিবার তাল পাখা তৈরী ও বিক্রির সাথে জড়িত ছিলেন। এখন আয়ুব আলী, ইব্রাহিম, তৈজুদ্দিনসহ পাঁচ ছয়টি পরিবার পাখা তৈরীর কাজ করেন।
একটি তালগাছের কয়েকটি পাতা কিনতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দিতে হয় গাছের মালিককে। একটি গাছের পাতা কাটতে শ্রমিককে দিতে হয় ১০০ টাকা। এছাড়া পরিবহণ খরচও আছে। তালপাতা বাড়িতে আনার পর রোদে শুকিয়ে আবার ছায়ায় ঠান্ডা করতে হয়। তারপর নির্ধারিত মাপে তালপাতা কাটতে হয়। বাঁশের তৈরি কাঁঠির মধ্যে তালপাতা পরিয়ে গুনা দিয়ে আটকাতে হয়। তারপর সুতা দিয়ে সেলাই করতে হয়। সবশেষে রং দিয়ে ইচ্ছামত ফুল, পাখি, গাছপালার ছাপ দেওয়া হয় তাল পাখায়।
বর্তমান প্রতিটি তালপাখা পাইকারী ৭ টাকা করে বিক্রি করছেন তারা। এলাকার পাখা ব্যবসায়ীরা গঙ্গা স্নাননোৎসব ও বৈশাখী মেলায় বেশি পাখা বিক্রি করেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর এলাকার পাখা ব্যবসায়ীরাও পাখা কিনে নিয়ে যান। বর্তমানে হাট বাজারে সহজে বহনযোগ্য কাগজ, প্লাস্টিকের অনেক ধরণের পাখা পাওয়া যায়। হয়তো এ কারণেই তাল পাখার কদর কমছে বলেও জানান তিনি।
এলাকাবাসী জানান, এ গ্রামে স্বচ্ছল পরিবারের সংখ্যা খুব কম। একসময় অনেকে তাল পাখা তৈরী ও বিক্রির সাথে যুক্ত থাকলে ক্রমশই সে সংখ্যা কমে আসছে। পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন তারা। যারা এ পেশায় এখনো কোন রকমে টিকে আছেন কালের বিবর্তনে তারাও হয়তো এ পেশা থেকে অন্য পেশায় চলে যাবেন।